ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত, একটি সমৃদ্ধ ও প্রাচীন সংগীতধারা, যার শিকড় প্রোথিত রয়েছে ভারতের বৈদিক যুগে। প্রায় ২০০০ বছরের বেশি পুরোনো এই সংগীতধারার উৎপত্তি মূলতঃ মন্দিরে পরিবেশিত স্তোত্র, মন্ত্র ও উপাসনামূলক আবৃত্তির মধ্য দিয়ে। সামবেদ হচ্ছে এই ধারার অন্যতম প্রাচীন দলিল, যেখানে সঙ্গীতকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত বিষয় হিসেবে আলোচিত করা হয়েছে।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত কেবল সুর-তাল-রাগের প্রকাশ নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, যা আত্মার মাধ্যমে বিশ্বচেতনাকে উপলব্ধির একটি মাধ্যম।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত
প্রধান দুটি ধারা
বর্তমানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের দুটি প্রধান শাখা প্রচলিত:
১। হিন্দুস্থানী সঙ্গীত (উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত)
২। কর্ণাটকী সঙ্গীত (দক্ষিণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত)
দুটি ধারার মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য থাকলেও উভয় সংগীতেই দুটি মূল উপাদান অপরিহার্য— রাগ ও তাল।
- রাগ: সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি (সপ্তস্বর) এবং ২২টি শ্রুতি-এর সমন্বয়ে গঠিত।
- তাল: সংগীতের ছন্দাত্মক কাঠামো, যা সময় ও গতি নির্দেশ করে।
হিন্দুস্থানী সঙ্গীত
হিন্দুস্থানী সঙ্গীত ভারতের উত্তরভাগে প্রসারিত, যার বিকাশ ঘটেছে বৈদিক চর্চা, লোকসংগীত, এবং পারস্যের সংগীত-ধারার মেলবন্ধনে। মুঘল আমলে পারস্যের বাদ্যযন্ত্র, গায়কী ও তালপ্রথা এর সঙ্গে যুক্ত হয়, ফলে এক নবধারার জন্ম হয় যা আজকের হিন্দুস্থানী উচ্চাঙ্গ সংগীত নামে পরিচিত।
গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য:
- রাগপ্রধান সংগীত, যেখানে সৃষ্টিশীলতা (improvisation) গুরুত্বপূর্ণ।
- ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা, তরানা, ইত্যাদি এর বিভিন্ন ঘরানা বা শৈলী।
- খেয়াল হচ্ছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘরানা, যা মূলত অলঙ্কারপ্রধান ও শিল্পসুষমায় ভরপুর।
- হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে পারফর্মিং আর্টসের তিনটি শাখা গুরুত্বপূর্ণ— গায়ন (ভোকাল), বাদন (ইনস্ট্রুমেন্টাল) ও নৃত্য।
প্রধান বাদ্যযন্ত্র:
সেতার, সরোদ, সারেঙ্গী, তবলা, তানপুরা, হারমোনিয়াম, বাঁশী, পাখোয়াজ ইত্যাদি।
ঠাট পদ্ধতি:
পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে রাগগুলিকে দশটি ঠাট-এ ভাগ করে একটি পদ্ধতিগত কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেন, যা আধুনিক হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কর্ণাটকী সঙ্গীত
কর্ণাটকী সঙ্গীত, দক্ষিণ ভারতের মূলধারার শাস্ত্রীয় সংগীত, আরও প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ধারা হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি তুলনামূলকভাবে কম বিদেশি প্রভাবে প্রভাবিত এবং এর ভক্তিমূলক চেতনাই মূল চালিকাশক্তি।
বৈশিষ্ট্য:
- কর্ণাটকী সঙ্গীতে ৭২টি মেলকার্তা রাগ বা স্কেল রয়েছে, যেগুলি থেকে হাজার হাজার রাগ তৈরি হয়েছে।
- তাল ব্যবস্থায় রয়েছে ১০৮টির বেশি বিভিন্ন তাল।
- কর্ণাটকী সঙ্গীত রচনায় ভক্তিমূলক ভাষা (তেলুগু, কন্নড়, সংস্কৃত, তামিল) ব্যবহৃত হয়।
প্রধান রচয়িতারা (ত্রয়ী):
- তিয়াগরাজা
- মুথুস্বামী দীক্ষিতর
- শ্যামা শাস্ত্রী
এদেরকে ত্রিমূর্তি বলা হয় কর্ণাটকী সংগীতের, যারা ১৮শ শতকে কর্ণাটকী সংগীতকে চূড়ান্ত শৈল্পিক অবস্থানে উন্নীত করেন।
বাদ্যযন্ত্র:
বীণা, মৃদঙ্গম, ভায়োলিন, ঘটম, কানজিরা, তানপুরা ইত্যাদি।
পুরন্দর দাস (১৪৮০-১৫৬৪):
তাঁকে কর্ণাটকী সঙ্গীতের পিতা বলা হয়। তিনি সঙ্গীতকে ধ্রুপদ থেকে শাস্ত্রীয় পর্যায়ে নিয়ে আসেন এবং একটি শ্রেণিবদ্ধ পদ্ধতির সূচনা করেন।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত কেবল সংগীত নয়— এটি এক আধ্যাত্মিক সাধনা। এর মধ্য দিয়ে আত্মার উন্মোচন ঘটে, জীবনের অভিব্যক্তি ঘটে, এবং বিশ্বচেতনাকে উপলব্ধি করা যায়। হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটকী, এই দুই ধারাই ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে আসছে সহস্রাব্দ ধরে, এবং এই ধারার সাধকগণ আজও বিশ্বজুড়ে এর দীপ্তি ছড়িয়ে চলেছেন।
📚 উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ:
- “সঙ্গীত রত্নাকর” – শার্ঙ্গদেব
- “রাগ বিবেক” – পণ্ডিত সোমনাথ
- “হিন্দুস্থানী সঙ্গীত কা ইতিহাস” – বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে
🎶 জনপ্রিয় শিল্পী ও গুরু:
- হিন্দুস্থানী: পণ্ডিত ভীমসেন যোশী, উস্তাদ আমজাদ আলি খান, কিশোরী আমোনকর
- কর্ণাটকী: এম.এস. সুব্বালক্ষ্মী, এল. সুব্রহ্মণ্যম, টি.এম. কৃষ্ণা